মহেশখালী মাতারবাড়িতে ভিড়ল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ

 


দেশের নৌবাণিজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ প্রবেশ করেছে বঙ্গোসাগরের তীরে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে বাস্তবায়নাধীন সমুদ্রবন্দরে। ২২৯ মিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের (পানিতে নিমজ্জিত অংশের গভীরতা) পানামার পতাকাবাহী জাহাজটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬৩ হাজার মেট্রিকটন কয়লা নিয়ে এসেছে।

পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসাবে গড়ে ওঠার আগেই বিশ্বের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ইতিহাস সৃষ্টি করলো মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর। এর মধ্য দিয়ে মাতারবাড়ি বিশ্বের গভীর সমুদ্রবন্দরের তালিকায় ঢোকার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।


মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মতবিনিময় সভায় বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘মাতারবাড়ি চ্যানেলে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে ইতোমধ্যে আমরা ১২০টির বেশি জাহাজের বার্থিং করেছি। আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ মাতারবাড়ির কয়লা জেটিতে ভিড়ছে। মাতারবাড়ি টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে ডীপ ড্রাফট ভেসেল তথা ১৬ মিটার বা তার চেয়ে বেশি গভীরতা সম্পন্ন বাণিজ্যিক জাহাজ গমনাগমন করতে সক্ষম হবে।’


কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে পূর্ণাঙ্গ গভীর বাণিজ্যিক বন্দর করার প্রকল্প ২০২০ সালের ১০ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন পায়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে মোট খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণও এই ব্যয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। শুধু সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি সংস্থা জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সহজ শর্তে মাত্র শূন্য দশমিক এক শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। সরকার যোগান দিচ্ছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করছে দুই হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা দেবে।


২০২১ সালের শেষদিকে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২৬ সালে কাজ শেষে মাতারবাড়ি বন্দরে পূর্ণাঙ্গ অপারেশন শুরু হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে প্রথম নোঙ্গর করে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা একটি জাহাজ। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণসামগ্রী ছিল। এরপর গত তিনবছরে আরও ১১১টি জাহাজ এই বন্দরে এসেছে। সর্বশেষ এল ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাহাজটি, প্রথমবারের মতো কয়লা নিয়ে।


জানা গেছে, পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এম ভি অউসু মারো সোমবার (২৪ এপ্রিল) মাতারবাড়ি উপকূলে এসে পৌঁছায়। বন্দরের তিন ও চার নম্বর কান্ডারীর পাশাপাশি আরও ২টি টাগবোটের সহায়তায় একজন পাইলট নতুন তৈরি ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার প্রস্থের চ্যানেল পাড়ি দিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে জাহাজটিকে জেটিতে নিয়ে আসেন।



ইন্দোনেশিয়ার তারহান বন্দর থেকে গত ১৩ এপ্রিল যাত্রা করেছিল এই জাহাজটি। ৮০ হাজার মেট্রিকটন সক্ষমতার জাহাজটি মাতারবাড়ি বন্দরের পাশ্ববর্তী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬৩ হাজার মেট্রিকটন কয়লা নিয়ে এসেছে। আর বড় এই জাহাজ সমুদ্রবন্দরে নিয়ে আসার জন্য দুই মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ।


এদিকে বন্দর দিবস উপলক্ষে শহীদ মো. ফজলুর রহমান মুন্সী অডিটোরিয়ামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছে। আগে কি-গ্র্যান্টি ক্রেনের সল্পতা ছিলো। এখন ১৮টি কি-গ্র্যান্টি ক্রেন আছে। এখন একটি ইকুইপমেন্ট অচল হলে আর অপেক্ষা করতে হয় না। সেটির পরিবর্তে অন্যটি এনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু উন্নত বন্দরে সবকিছু অটোমেশনে পরিচালিত হয়।’


আগামীতে বন্দর অটোমেশন প্রযুক্তিতে পরিচালিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরেও যেন সবকিছু অটোমেশনে হয়, সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। তাই বলা যায়, আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত হবে অটোমেশন প্রযুক্তিতে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে রূপান্তর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগকে অটোমেশন করতে ৫০টি সফটওয়্যার মডিউল তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে বন্দরকে পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব হবে।’


বিপজ্জনক, তেজস্ক্রিয়, রাসায়নিক পণ্য নিরাপদে আমদানি রফতানির সুবিধার্থে স্টেট-অব-আর্ট কেমিক্যাল শেড গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পোর্ট লিমিট ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬২ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। রফতানি কনটেইনার স্ক্যান করতে ২টি আধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুন নাগাদ স্থাপন সম্ভব হবে। হামিদচরে লাইটারেজ জেটি তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘বন্দরের পাইলটদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে ২১০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ১০ মিটার জাহাজ ভিড়ানো যাবে। হজযাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ বার্থিংয়ের সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর মোহনার তীরে ২০০ মিটারের যাত্রীবাহী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষা চলছে। ’


বন্দরের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা তুলে ধরে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এক দশকে ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করায় কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ৫৫ হাজার টিইইউসে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে শিপ টু শোর কি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩১০টি ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৮টি কি গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে বন্দরে। ইজি অব ডুয়িং বিজনেসের সব সূচক আমরা দ্রুত অর্জন করেছি।’


‘ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষম। ইতিমধ্যে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি ট্রায়াল রান সফল হয়েছে। কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন করেছি আমরা। বন্দরের বার্থিং ডিজিটালি হয়ে থাকে। এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে।’


পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পিটিসিতে (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) ইতোমধ্যে একটি মাদারভ‌্যাসেল ভিড়েছে। পিটিসি অপারেশনে নিতে আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপারেটর খুঁজছি। আন্তর্জাতিক অপারেটর নেওয়া কারণ হলো তাদের কাজের সাথে তুলনা করে আমরা প্রতিযোগিতা করে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে পারবো। এছাড়া দেশ আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। পিটিসি চালু হলে পয়েন্ট (দশমিক) ৪৫ মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাড়বে।’


বে-টার্মিনাল প্রসঙ্গে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বে টার্মিনালে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ কাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। নিষ্কণ্টক জমি নামমাত্র বা প্রতীকী মূল্যে পেতে যাচ্ছি। বে-টার্মিনালে তিনটি টার্মিনাল হবে। সেটার মাস্টারপ্ল্যানও প্রস্তুত হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ে বে-টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’


চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে অন অ্যারাইবল বার্থিং দেওয়া হচ্ছে। ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিসহ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বছরে সাড়ে ৪ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রার এ টার্মিনালে ২০০ মিটার লম্বা ১০ মিটার ড্রাফটের ২টি কনটেইনার জাহাজ এবং ২২০ মিটার লম্বা ডলফিন জেটিতে তেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে।’


‘টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি অপারেটর দ্বারা পরিচালনার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পিপিপি কর্তৃক ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর হিসেবে আইএফসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ট্রানজেকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট দিলে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’


ইউএস রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এমভি সোঙ্গা চিতা ৯৫২ কনটেইনার রফতানি পণ্য নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট বিলম্ব না থাকায় ১২-১৫ দিনের মধ্যে ১০-১২ হাজার ডলার খরচে রফতানি পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন চূড়ান্ত গন্তব্যে যাচ্ছে। এতে সময় সাশ্রয় হচ্ছে ১৫-১৬ দিন, প্রতি কনটেইনারে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ডলার। ইউরোপের মতো ইউএসএ রুটে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল সেবা চালু করতে কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে।’


সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান। এছাড়া সভায় বন্দরের বোর্ড সদস্য, পরিচালক, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।


উল্লেখ্য, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০ ফুট দীর্ঘ ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ৩৬১টি



মন্তব্যসমূহ